By সায়ন কুমার দে ( Sayan Kumar De)
.....যৌবন পেরিয়ে, প্রৌঢ়ত্বকে পেছনে ফেলে...বার্ধক্যে উপনীত এই আমিটা, আজ বড্ড একা। ফেলে এসেছি অনেকটা পথ, অনেকটা জীবনের অংশ, যা বারংবারই চাবুকের আঘাতের ন্যায় ফিরে ফিরে আসে আমাতে।।
ভুল ছিল আমার, ভুল ছিল আমাদের।।
একটা সময় আসে, যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ছিন্ন করে, এগিয়ে চলার স্পৃহা...মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। হতে পারে সেটা যৌবনের আবেগ মিশ্রিত রক্তের উষ্ণতার দ্বারা সৃষ্ট শক্তির ফল। যাকে সোজা ভাষায় "তেজ" বলে। আমরা উপলব্ধি করতে পারি, একটা dynamic শক্তির প্রবাহ, যা ক্রমশ তথা ক্রমাগতই প্রবাহিত হয়, প্রতিটি শিরা উপশিরার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু সেটা কতদিন?
ঘোড়দৌড়ে...সামীল হওয়া আমরা, দৌড়ে চলেছি...প্রতিনিয়ত। পেরোচ্ছি, এক-একটি দিন, এক-একটি প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা। আমরা লড়ছি, আমরা ঠকছি....আমরা করছি ভুল!
কিন্তু প্রশ্ন হল, " আমাদের কৃত শেষ ভুল থেকে, আমরা কিছু শিখতে পেরেছি?"
কিছু কিছু স্মৃতি হয় খুব আপন, যা আমাদের শেখায়...সেই সমস্ত জিনিস, যেগুলো কোনো ভালো পুস্তক আমাদের শেখাতে পারে না।
.....আমার আজও মনে পড়ে, সেই দিনের কথা, যেদিন...আমার মা -এবং বাবা, উভয়েই নিয়ে গিয়েছিলেন দার্জিলিং, বেড়াতে। তখন আমি খুব ছোটো।
"উচ্চতাতে" আমার ভয় নেই। তবে, রোপওয়ে -তে উঠতে বারংবারই, আমায় অস্বঃস্তির ঢোক গিলতে হয়েছিল।
তাই অগত্যা "সাধ থাকা, অথচ...সাধ্যে না কুলোনো" এই বেচারা আমিটাকে একপ্রকার প্রায় কোল-পাঁজা করেই, আমার বাবা, খাড়াই পথ অতিক্রম করেই নিয়ে গিয়েছিলেন "কান্চন জঙ্ঘা", view point " tiger hill".
চাতক পাখির মত, তাকিয়ে থাকা দর্শক বৃন্দরা, অপেক্ষায় ছিলেন...কখন সেই মাহিন্দ্র-ক্ষনে রাত পেরিয়ে ভোরের সবেমাত্র আলোর ছটা এসে পাহাড়ের চূড়াকে আলোকিত করেই, ঠিকরে, উপনীত... হবে তাহাদের চোখে।। যদিও...সেই চাতক পাখিদের দলে, "-দে" পরিবারের তিনজন চাতক পাখিও ছিল, বটে।।
উপনীত হল সেই মাহিন্দ্র ক্ষন।।আমরা স্তব্ধ, আমরা বিচলিত, মোহে আচ্ছন্ন!!
যেন হঠাৎ আগত, সূর্য রশ্মির শোভা এবং ভোরের অতিশীতলতা...একপ্রকার পক্ষাঘাত হেনেছিল, আমাদের মনে তথা দেহে।।
আমার বাবা, সেই মুহূর্তে একটা কথা বলেছিলেন। তার গভীরতা আজ এই বয়সে এসে স্বচ্ছতার সাথে বুঝে উঠতে, শ্লেষ মাত্র টুকুও হয় না।
ঊঁনি বলেছিলেন, " এত উঁচুতে, কত সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সাথে, যে পথ দিয়ে আমরা হেঁটে এসেছিলাম...সেই পথটি কিন্তু কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে, দেখা যাচ্ছে না।
ঠিক্ তেমনই হল, মানুষের জীবন, বাবা...' উচ্চতাতে উঠে অনেক সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় ঠিকই...কিন্তু কক্ষনও, নিজের পেরিয়ে আসা সিঁড়ির ধাপ গুলোকে ভুলে যেও না। ভুলে যেও না তোমার 'শেকড়' "।।
বছর ৬-৭ এর ছেলে তখন, কথার থেকে প্রকৃতির প্রতি মুগ্ধ হলেও, বছর... ৫৭-র এই বুড়োটি এখন ঠিক উলটো। হয়ত একেই বলে " সময়ের শিক্ষা!"।
এর পর সময় এগোলো..., বাড় বাড়ন্ত ধরল শরীর, স্বাস্থ্যের এবং মনের।
ধীরে ধীরে সংসার জীবনের প্রবেশ করতে হল, এই বাউন্ডুলে আমিটিকে।।
তারুন্যের লাবণ্য, ঢাকা পড়ে যেতে লাগল...কুঁচকোনো চামড়ার ভাঁজে। ধীরে ধীরে, সাদা-কালোর রামধনুতে ঢাকা পড়ল, মা -বাবার মাথা।
যারা এতদিন, আমার আবদার মিটিয়ে এসেছে, তারাই এহেন...এক মুঠো সুখ, এক মুঠো আহ্লাদের বায়না করতে শুরু করল আমাকে।
শিশুর মত, আবদারের ডালি...সাজিয়ে, দেওয়া হত আমাকে।
ধীরে-ধীরে, সময়েরও বাড়ল বয়স। আমরাও কর্মব্যাস্ত হয়ে পড়তে শুরু করলাম। ফলত, বাবা -মা য়ের প্রতি সময় দেওয়ার প্রবণতা কিংবা মানসিকতা ক্রমশ হারিয়ে যেতে শুরু করল। কর্ম-মুখর তথা, কর্ম-ব্যাস্ত আমরা, এতটাই দূরে সরে গেলাম যে, মা -বাবার চিকিৎসাও হল দূর থেকে।।
এত দূর থেকে, যে... আমাদের পক্ষ থেকে খোঁজ টুকু নেওয়াও সম্ভবপর হয়ে উঠল না।
আজ দু'জনের কেউই আমাদের মধ্যে নেই। শুধু রয়ে গেছে, তাঁহাদের কথা, তাঁহাদের স্মৃতি মাখা জিনিস গুলোর সারি।
বাবার ডাঁটি ভাংগা চশমা আর, অক্ষত আরাম কেদারাটিকে, প্রতিনিয়তই আমি পরিষ্কার করি।। মায়ের "শাল", আজও আমায় মায়ের স্পর্শের অনুভূতি দেয়।।
ভুলতে পারিনা, আজও সেই সময়ের কথা... যে সময় ওঁনারা উপস্থিত ছিলেন।
কিন্তু আজ তাঁরা দূরে....বহুদূরে। তাঁদের শূন্যতা...গ্রাস করে আমায়, প্রতিনিয়ত।। প্রতিদিনই আমি আবারও ফিরে পেতে চাই তাঁদের।
এতগুলো বছর পেরিয়ে, জীবনরূপী পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে... নিজেকে জিজ্ঞেস করি,
" আচ্ছা?...যে মানুষ গুলোর জন্য এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছি, তাদের দেওয়ার মতো সময়টুকু ছিল না আমার?"
তাঁদের, একটি বার ফিরে পেয়ে, জড়িয়ে ধরে বলতে চাই, " ভুল ছিল আমার। ভুল ছিল আমাদের।।"
By সায়ন কুমার দে ( Sayan Kumar De)
Comments