By Sanchita Kar
তৃষা আর উৎসব লঙ ড্রাইভে যেতে খুবই ভালোবাসে। মাঝে মাঝেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে এদিক ওদিক। দূর দূর অব্দি গাছপালা ঘেরা রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে চলে যায়, কাছে পিঠে কোনো ধাবা কিংবা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার ফিরে আসে। ওরা পেশায় দুজনেই সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তাই শনিবার আর রবিবার করে ওরা বেরিয়ে পরে নিজেদের সারা সপ্তাহের ক্লান্তি মেটাতে। তৃষা উৎসবের জ্যাঠতুত দিদি। ওর থেকে প্রায় বছর পাঁচেকের বড়।
সেদিনও তেমনই শনিবার দেখে বেরিয়েছিল ওরা। প্ল্যান ছিল একটা রিসর্টে রাত কাটিয়ে আবার পরের দিন ফিরে আসবে। সেই মত বুকিংও করে রাখলো। রাস্তায় যেতে যেতে নতুন হিন্দি গানের সাথে বেসুরো গলা মিলিয়ে দুজনেই গাইতে গাইতে বেশ অনেকটা রাস্তা গেল। মাঝপথে একটা ধাবায় থেমে গরম গরম রুটি তরকা দিয়ে দুপুরের খাওয়াটা সেরে দুজনেই তৃপ্ত হলো।
তবে গাড়িতে ফিরে এসে তৃষা বায়না ধরলো এবার গাড়ি সে চালাবে। দিদির ড্রাইভিংয়ের ওপর উৎসবের মোটেই ভরসা নেই। বেশ অনেকবারই এদিক সেদিক ঠুকে দিয়েছে গাড়ি নিয়ে। তাই তৃষাকে কিছুতেই হুইল ছাড়লো না উৎসব। ভাইয়ের ওপর অভিমান দেখিয়েও যখন লাভ হলো না, তখন সে মুখ গোমড়া করে পাশের সিটে বসে পড়লো।
যেতে যেতে দিদির পছন্দের গান চালিয়ে ওকে ভোলানোর চেষ্টাও করলো অনেক। সাথে বোকা বোকা জোকস বা মজাদার গল্প। শেষে উৎসবের কার্যকলাপ দেখে তৃষা হেসেই ফেললো। তবে এইসব মজার মধ্যে ঘটে গেল এক বিপত্তি। রাস্তা ভুল করে সঠিক গলিটা পেরিয়ে অনেকটা চলে আসায় সামনের কিছুই মাপের সাথে মিলল না। বড় রাস্তার মাঝেই গাড়িটাও হঠাৎ গো গো করে বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধেও হয়ে এসেছে। খুব বেশিক্ষণ গাড়িতেই কাটালে, আর রাতের আস্তানা মিলবে না। এই ভেবে ওরা গাড়ি থেকে নেমে সামনের দিকে এগোলো, যদি কিছু পাওয়া যায়। বেশ দূর অব্দি সামনে পেছনে কিছুই চোখে পড়লো না। তবে আরও কিছুটা এগোতেই একটা সুন্দর ছোট বাড়ি নজরে এলো। বাড়িটার সামনে বিশাল বড় বাগান।
বাড়িটার গেটের ওপরে সবুজ রং দিয়ে বোর্ডে লেখা “সুজলা লজ”। সুজলাই বটে। বাগানে যে কত নাম না জানা ফুল আর লতা গাছ তার ঠিক নেই। একটু দূরেই যে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়ে যাবে, এটা ওরা আশা করেনি। তাই এই আকস্মিক ঘটনায় দুজনেই বেজায় খুশি হলো। বাগান পেরিয়ে সদর দরজায় বেল বাজালো তৃষা। ওদের কাছে লাগেজ বলতে শুধু একটা করে রুকস্যাক। ওরা শুনতে পেল ভেতর থেকে একজন বৃদ্ধা খোনা গলায় বললেন, “যাই”।
দরজা খুললো এক সাদা শাড়ি পরিহিতা বৃদ্ধা মহিলা। নমস্কার করে বললো, “আমি সুজাতা রায়। এই লজের মালকিন”। ওরাও প্রতিনমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, “রাতের জন্য একটা ঘর পাওয়া যাবে? আমাদের গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। একটু যদি বাবস্থা করে দেন”। সেই শুনে বৃদ্ধা বলল, “হ্যা হ্যা এসো, আজকে লজ প্রায় পুরোই ফাঁকা। এসো এসো”।
এই বলে বৃদ্ধা ওদের বাড়ির ডান দিকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে একটা বড় বিছানা, একটা আলনা আর একটা সাইড টেবিল ছাড়া কোনো আসবাব পত্র চোখে পড়লো না। বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করলেন, “দেখো তো ঘরটা পছন্দ হয়েছে?” ওরা ইতিবাচক ঘাড় নেড়ে বৃদ্ধাকে আশ্বস্ত করলো। ঘর পছন্দ করে ওরা গেল বসার ঘরে। ওখানেই একটা টেবিল চেয়ার পেতে রিসেপশন এর জায়গা তৈরি করা হয়েছে।
টেবিলে রাখা খাতা খুলে বৃদ্ধা ওদের নাম আর ঘরের নম্বরটা লিখে নিলেন। তৃষা দেখল ওদের আগে আরো তিনজনের নাম লেখা ওই পাতায়। তার মধ্যে একজনের নামের পাশে টিক চিহ্ন দেওয়া। বাড়িটার সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই বসার ঘর। দুপাশে দুটো অতিথির ঘর। পেছনে একটা রান্নাঘর, ডাইনিং হল আর তার পেছনে আরও দুটো ঘর। সামনে বাগান আর পেছনে একটা ছোট তালা মারা গোদাম ঘর। ওদের সোফায় বসতে বলে উনি ভেতর থেকে একটা ফ্লাস্ক আর তিনটে কাপ নিয়ে এলেন। তাতে চা ঢেলে দিলেন। সাথে মারি বিস্কুট। বেশ ঘরোয়া একটা ছিমছাম ভাব আছে জায়গাটার।
বৃদ্ধা আরাম করে চেয়ারে বসে বললেন, “তোমরা রাতে কি খাবে একটু সন্ধে ছটার মধ্যে জানিয়ে দিয়ো। রুটি ভাত সবই মিলবে। লোক বলতে তো এই আমি আর তিনজন অতিথি। তোমরা ছাড়া আর কেবল একজন লেখক ভদ্রলোক এসেছেন নিরিবিলিতে সময় কাটাতে। এই জায়গাটা একটু ভেতর দিকে বলে বড় একটা কাস্টমার পাইনা”। তৃষা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা খাতায় যে আর একজনের নাম দেখলাম, উনি কি নেই?” বৃদ্ধা বললেন, “না উনি চলে গেছেন। ওর যাওয়ার তারিখটা লেখা হয়নি। ভালো মনে করিয়েছো” তৃষা এসে থেকেই বাগানটা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ছিল। এবার আর কৌতূহল সামলাতে না পেরে বললো, “আর কিছু যদি মনে না করেন তাহলে কি বাগানটা একটু দেখা যায়? আসলে এত সুন্দর লাগছে। এইসব গাছ আমাদের ঐদিকে দেখিনি কখনো”। বৃদ্ধা হেসে বললেন, “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, কিছু মনে করবো কেনো? বরং আমার বাগান কেউ দেখতে চাইলে আমার ভালই লাগে”। এই বলে উনি ওদের বাগানে নিয়ে গেলেন।
বাগানে অর্কিড জাতীয় প্রচুর ফুল। আর সাথে লতানে গাছ। একটা আরেকটার উপর জড়িয়ে রয়েছে। প্রায় সব গাছেই ছোট ছোট নরম কাটা জাতিয় রোয়া। বৃদ্ধা ঘুরতে ঘুরতে বললেন, “এই ফুল গাছগুলো আমাকে এক কাকা উপহার দিয়েছিলেন। উনি অনেক পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতেন আর সেখানেই নাকি এসব পাওয়া যায়। সব ফুলের নাম ও অতো আর মনে নেই এখন। এর পরিচর্যা করাও বেশ কঠিন। কোনো গাছে হাত দিয়ো নাযেন”। “কি সার ব্যাবহার করেন?”, জানতে চাইল তৃষা। বৃদ্ধা সে কথার উত্তর না দিয়ে বললো, “চলো তোমাদের আমার সব চেয়ে প্রিয় গাছটা দেখাই”। তৃষা বুঝলো বুড়ি গাছ দেখাতে ভালোবাসলেও, সে চায়না তার মতো এই গাছ আর কেউ করুক। তাইজন্যই সারের কথাটা বেমালুম এড়িয়ে গেল।
সে যা হোক, ওরা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বাগান দেখে ফেরার পর রাতের খাবারের কথা বলে দিয়ে রুমে গেল একটু রেস্ট করতে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে উৎসব ফোন ঘাটতে ঘাটতে বললো, “এই সুজাতা, মানে লজের মালকিন, কি অদ্ভুত না? তুই যখন সারের কথা জানতে চাইলি, দেখলি কি ভাবে তাকালো? কেমন অস্বস্তিকর একটা হাসি লেগে থাকে ওনার মুখে। তাকানোটাও অদ্ভুত। কাল সকালটা হলে বাঁচি। ধুর এই উইকএন্ডটাই মাটি হয়ে গেলো লাগছে”। ভাইকে সান্তনা দিয়ে তৃষা বললো, “আরে না না হয়তো দেখ নিজের সিক্রেট কাউকে জানাতে চায়না। অনেক ট্যালেন্টেড মানুষই এটা করে থাকে। উনিও হয়ত তেমনই”। উৎসব মুখ বেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বালিশে হেলান দিয়ে বসলো।
রাতে খাওয়া শেষ করে ঘরে আসতেই দুই ভাই বোন ঘুমে ঢলে পড়ল। ওদের এতোই ঘুম পেয়েছিল যে ঘরের দরজাটা পর্যন্ত ঠিক করে লাগাতে ভুলে গেল। বৃদ্ধা টেবিল পরিষ্কার করতে করতে একবার আড় চোখে ওদের দেখলেন। তারপর পাশের ঘরে একই অবস্থায় পড়ে থাকা লেখক ভদ্রলোকটির দিকে তাকালেন। মুচকি হেসে বাগানের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই বললেন, “এবার আর তোদের সারের অভাবে মরতে হবে না”।
উৎসবের ঘুম ভাঙ্গলো প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসায়। কোনো মতে ঘুম কাটিয়ে সে অনুভব করে কিছু একটা জিনিস তার গলাটাকে আস্টে পৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। সে কিছু ঠাওর করতে পারার আগেই পাশ থেকে আর একটা পুরুষ কণ্ঠে আর্তনাদ ভেসে আসে। বুঝলো সেই লেখকের গলা এটা। দুহাতে গলায় চেপে বসে থাকা জিনিসটাটাকে সরাতে গিয়ে এক অসম্ভব ব্যাথা অনুভব করলো। সেই সঙ্গেই বুঝতে পারলো যে ওরা বাগানে রয়েছে। আর সেখানেই একটা লতা গাছ ওদের আকড়ে ধরেছে। একটা নরম লতায় কিভাবে এত শক্তি থাকে, তা উৎসবের মাথায় ঢুকলো না। পাশেই তৃষার গোঙানির শব্দে বুঝলো ওর ও একই অবস্থা।
আশপাশ থেকে আরও লতা আর ফুল যেন ওর ওপর ঝুঁকে এলো। আর ওদের ওই আপাত দৃষ্টিতে নরম রোয়া গুলো নির্বিঘ্নে ওদের চামড়া ভেদ করে শরীরে ঢুকিয়ে দিল। অনেকগুলো সূচ একসাথে গায়ে বিধে যাওয়ার যন্ত্রনায় কোকিয়ে উঠলো উৎসব। ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে শরীরটা। খুব শিগগিরি এর কবল থেকে না বেরোলে আর এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে ফেরা হবে না। হঠাৎ ওর মনে পড়লো ওর প্যান্টের পকেটে একটা সুইস নাইফ সব সময়ই থাকে। কোনো রকমে একটা হাত দিয়ে অন্য হাতের লতা গুলো টেনে ছাড়িয়ে ছুরিটা বের করল। বিন্দু বিন্দু রক্ত্বে ভেসে যাচ্ছে শরীর।
অতি কষ্টে গলায় চেপে বসা লতাটাকে কাটার সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করলো গাছটা থেকে। নিজের গলার ক্ষতটাও চেপে ধরল রক্তপাত আটকাতে। বাকি লতাগুলোকেও হিংস্র ভাবে উপড়ে ফেললো শরীর থেকে। উৎসবের সারা গা তখন রক্তে ভেজা। রাতের অন্ধকারে সেই ক্ষত বিক্ষত শরীর নিয়েই কোনো মতে দিদিকে খুঁজে ওকেও লতার জাল থেকে কেটে বের করলো। এই পৈশাচিক বাগানে আর এক মুহূর্তও কাটালে ওরা বাঁচবে না। কাঁচা রক্তের লালসায় সামনে থেকে ধেয়ে আসা রাক্ষুসে ফুলগুলোকে কাটতে কাটতে কোনো মতে এগোলো ওরা। বেশ কিছুটা দূরে লেখক ভদ্রলোককে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ওরা তাড়াতাড়ি সেদিকে এগিয়ে গেলো, যদি লোকটা বেঁচে থাকে তাহলে তাকেও সঙ্গে নিয়ে নেবে।
বাগানটা যেনো হঠাৎ করেই অপরিসীম হয়ে উঠেছে। লোকটার কাছে পৌঁছতেই ওদের রীতিমত বেগ পেতে হলো। তবে পৌঁছেও লাভ হলো না। কেবল ফ্যাকাশে খোলস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ততক্ষণে। সদ্য একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের রক্ত শুষে গাছগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আর অত্যধিক রক্তপাতে ওদের শক্তি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। সেই অবস্থাতেই ওরা প্রাণপণ শক্তি লাগিয়ে এগিয়ে চললো। হঠাৎ একটা খোনা গলা পেয়ে দুজনেই মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। “এ কি রে বাছারা, তোরা খাচ্ছিস না যে ঠিক করে! এরম করলে বড় হবি কি করে বলতো? একি, বাকি দুটো কই গেল? তোকে এভাবে কাটল কে? শয়তান, ফিরে আয় শয়তান।” বুড়ির চিৎকার ভেসে আসছে।
লতাগুলোও যেন জানে কে ওদের খাদ্য আর কে ওদের রক্ষিকা। আপনা থেকেই সরে গিয়ে বুড়িকে এগোনোর রাস্তা করে দিল। ওরা আর পেছনে না তাকিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগোতে লাগলো। তবে খুব শিগগিরিই বুড়ি ওদের ধরে ফেললো। অবশ্য বলা ভালো গাছগুলো পথ আটকাতে সফল হলো। লতা গাছগুলো এখন দানবিক আকার ধারন করেছে। ওদের মাটি থেকে শূন্যে তুলে দিল অনায়াসে। সুজাতা তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “তোরা পালাচ্ছিশ যে বড়? সাহস তো কম নয়। কতদিন যে খেতে পায়নি বাছাগুলো আমার। আহারে। এই গাছ তো আর যে সে গাছ নয়”। দূরের দিকে চেয়ে পুরনো কথা মনে করে, গলার হারটাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কাকা যখন পাহাড়ে ঘুরতেন, তখন কোন এক সাধু নাকি এই লকেটের সাহায্যে এই গাছগুলোকে দিয়ে নিজের কাজ করতেন। ওদের বশে রাখতেন। তারপর কাকা সেই সাধুর থেকে এইটা চুরি করে আনলো। সাথে কতগুলো ওই রক্তখেকো লতা আর ফুলের গাছ। তবে এখানে তো তেমন লোকজন আসেনা, এলে কেউ ফিরে যায়না বলে পুলিশও হানা দিয়েছিল। সেও ফিরে যায়নি”। এই বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল বুড়ি।
ততক্ষণে উৎসব নিজের ছুরিটা শক্ত করে ধরে বুড়িকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল। অভ্যর্থ নিশানায় ছুরিটা বুড়ির হাতে লাগতেই সে লকেটটা ছেরে আর্তনাদ করে উঠলো। লকেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সাথে সাথেই লতার বাঁধন একটু আলগা হলো। ঠিক সেই সময় তৃষা ঝাঁপিয়ে পড়লো বুড়ির ওপর আর লকেটটা খুলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বয়স্ক সুজাতাও কম যায়না। সে ওই রক্তাক্ত হাতেই চেপে ধরলো লকেটটা। এই কাড়াকাড়ির ঠেলায় গাছগুলো উথাল পাথাল হয়ে দুলতে লাগলো আর সেই সাথে উৎসবও আছড়ে পড়লো। আর উপায় না পেয়ে, তৃষা কাছেই পড়ে থাকা ছুড়িটা সজোরে বুড়ির হাতে আবার বিধিয়ে দিল। এবার কাজ হোল। সে ব্যাথায় হারটা ছেড়ে দিতেই তৃষা এক টানে সেটা ওর গলা থেকে খুলে নিল।
রক্ত পিপাসায় গাছগুলো তখন পাগলের মত দুলছে। হারের জাদুই শক্তি প্রয়োগ করে গাছগুলো কে বাধ্য করল উৎসবকে ছাড়তে। উৎসবকে তৎক্ষণাৎ সরিয়ে নিয়ে এসে ওরা দুজনই প্রাণপণ ছুটলো গেটের দিকে। বেরিয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মত দেখল বুড়ির দেহটাকে পুতুলের মত শূন্যে তুলে নিল একটা প্রকান্ড লতার ঝাড়। তার শরীর এফোর ওফোর করে ঢুকে গেলো শয়ে শয়ে রোয়া। ওরা আর দেখতে পারলো না এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। দৌড়াতে দৌড়াতে বড় রাস্তা অব্দি পৌঁছতে পেরেছিল কোনমতে। তারপরই জ্ঞান হারায় ওরা।
পরের দিন জ্ঞান ফিরলে তৃষা দেখে একটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে সে। একজন নার্স ঘরে ঢুকতেই তৃষা কোনমতে জিজ্ঞেস করল, “উৎসব কোথায়? ও আমার ভাই, আমার সাথেই ছিল। ও কোথায়?” নার্স তাড়াতাড়ি ওকে সামলে বললেন, “আপনি এতো ব্যস্ত হবেন না। উৎসব নামের একজন মেল ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে। উনিও এখন সুস্থই আছেন। আপনি একটু দয়া করে শান্ত হন”। উৎসবের খবর জানতে পেরে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলো তৃষা। নার্সের থেকে নিজের ফোনটাও চেয়ে নিল।
পরদিন পুলিশের কাছে ভাই বোন কেউই মুখ খুললো না। আগে থেকেই ফোনে আলোচোনা করে পুলিশকে বললো রিসর্টে যাওয়ার সময় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওরা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেছিল। তবে ওখানের কাটা গাছে হাত পা কেটে বাজে অবস্থা হওয়ায় ওরা আবার বেরিয়ে আসে। তবে ওষুধ তেমন ছিল না আর সারাদিন না খেয়ে থাকার ফলে ওরা অজ্ঞান হয়ে গেছিল। সৌভাগ্যবশত পুলিশও ব্যাপারটাকে আর গুরুত্ব দিল না।
তার এক সপ্তাহ পর দুজনকেই বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল ওদের বাড়ির লোক। আজও সেই রাত্রের কথা মনে পড়লে ওদের গা শিউরে ওঠে। তৃষার মা ওর জামা আর জিন্স প্যান্টটা বারান্দায় মেলে ঘরে ঢুকে গেলেন। তৃষাও ঘরের ভেতরে চা খাচ্ছিল আর মা এর সাথে টুকটাক কথা বলছিল। ডাক্তারের হুকুমে এখন উৎসব আর তৃষা বাড়িতেই বন্দি। সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে তবেই অফিসে যাওয়া যাবে। অগত্যা মা এর সাথে গল্প করে সময় কাটাতে হচ্ছে। দুজনেরই কেউই লক্ষ্য করল না কখন ওর প্যান্ট থেকে একটা ছোট্ট সাদাটে লকেট বারান্দায় রাখা টগর গাছের টবটাতে গিয়ে পড়লো। আর গাছটাও কেমন যেন একটু অকৃত্রিম ভাবে দুলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
By Sanchita Kar
Comments