By Gayatri Roy
মাটির পুতুল
প্রবল আষাঢ়। মাটির দাওয়ার গা গড়িয়ে জল নামছে। ঊনানের আঁচে বসেছে নতুন মাটির হাঁড়ি। ভালো করে কাদার প্রলেপ মাখানো হয়েছে। দাওয়ার কুপিটা ঝোড়ো হাওয়ায় একবার নিভু হতে হতে আবার জ্বলে উঠছে।
আম্মা দাওয়া থেকে আকাশে চায় আর সমানে বলে - "জলের হাওয়া দেছে রে মনো, সব ভাসায় দিব"। কানুদের বাড়ির পুকুর পাড়ে বসে কুনোব্যাঙ গ্যাঙর গ্যাং ডেকেই চলে। ছেলেবেলায় শুনেছি ব্যাঙ বর্ষা চায় বলে ডাকে। ষোল কলা পূর্ণ করা ষোড়শী চাঁদ যেন আজ অষ্টাদশী। ছেঁড়া তালপাতা, বাগদী ঘুঙুর চুঁয়ে জ্যোৎস্না নেমে পুকুর পাড়ের চাতালে এসে পড়ে এই দিন। কিন্তু আজ আকাশ যেন পণ করেছে চন্দ্রাবতী কে অদৃশ্যই করে রাখবে। বটের খসখসে পাতার উপর পড়ে বৃষ্টি ঝর্ণা হয়ে নামছে কোন এক অবুঝ বালিকার মাথায় যেমন একরাশ মেঘের মতো ঢেউ খেলানো চুল নামে তেমন। আকাশের ত্বক আজ ঢিলে হতে হতে উপুড় হয়ে পড়েছে পৃথিবীর মাটিতে। যতটা নিচে নামলে ঠিক মাটিকে ছোঁয়া যায় ততটাই নিচে আজ আকাশ।
হ্যারিকেনের দুপাশে কাগজের ঢাকনা দেওয়া হয়েছে যাতে হাওয়া এসে আলো নিভাতে না পারে। ঝিঁঝিঁর ডাক বাড়ির পিছন দিকটায় হতে হতে সুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ফানুসের মতো। একা বাউল দূরের আখড়ায় মেঘ রাগের গান ধরেছে — "ঝরো ঝরো বরিষে বারিধারা"।
গ্রামের মেঠো আল, ভাদ্র মাস, মরা পুকুর পেরিয়ে আজ অনেক দূরের শহর। কড়ি বরগার কষাকষি, জানলার ঘুলঘুলি পেরিয়ে এখন শুধু ইট, বালি, সুড়কি। বুনোফুল, ঘেঁটু ফুল কোথাও নেই।আছে সগর্বে মাথা তোলা আকাশ ছোঁয়া সব নাম — বাগান বিলাস, গন্ধরাজ, গোলাপ, জারুল, জুঁই - এসব। মা এখন আর আটপৌরে শাড়ি পরেন না। কুচি দিয়ে আঁচল সাপটে শাড়ি পরেন শহুরে বিবিয়ানায় অভ্যস্ত নারীদের মতো। গ্রামের রহমান চাচাকে আর দেখি না, ইফতার করতে বসে সেই আবেগ বিহ্বল ডাক আর চাচীর শুনতে পাই না।এখানেও আজানের সময় মাইকে আল্লাহু আকবর শোনা যায়। সকাল হলেই রাস্তার মোড়ে হরিদার চায়ের দোকানে কাঁচের গ্লাসে চামচ নেড়ে চিনি গোলার শব্দ শুনতে পাই। অশ্বত্থ গাছের কোমর গুলো লাল লাল সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে। তার নিচে রাখা কালো পাথরে মেটে সিঁদুর পরিয়ে আগরবাতি জ্বালানো থাকে। তোমার সাথে গঙ্গা দেখতে গিয়ে অনেক সময় নিবিড়তায় ভুগেছি দুজনেই। কিন্তু সাহস করে একে অপরের হাতের গরম তালু দুটোকে একত্র করতে পারিনি। তবে এখানে কিন্তু সবাই বেশ সাবলীল। এখানে মাটির পুতুল গুলো বেশ শহুরে ধাঁচে তৈরি। গায়ের সাথে সাপটানো শাড়ি, চুমকি বসানো কাজ করা কুচি নিয়ে মেয়ে পুতুলগুলোর চোখে যেন নেশা। পুতুল নাচ দেখতে গিয়ে মনে পড়ে সেই গান — "নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে"।
কাঠের বীজের মালা গুনতে গুনতে অল্প বয়সি কাকা টা আমার সমাধিস্থ হল।সবাই বলল পুণ্য করে দেহত্যাগী হয়েছে বেটা। মনে হলো কোথাও কোনো নিবিড় জন অরণ্যে আমি তলিয়ে যাচ্ছি। আর তো সেই কাক ভোরে উঠে কাকার হাত ধরে ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে ফুল চুরি করে মসজিদে পীরের থানে দিয়ে তারপর বাকি ফুল নিয়ে মাকে দেওয়া— হবে না। পেয়ারা গাছের কচি ডাল দিয়ে, নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজা- এগুলো কোথাও যেন হুঠ করে মিলিয়ে গেল। কাকার গলার সেই গানটা কেউ গায় না আর —"এমন যদি হতো আমি পাখির মতো উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ"।
The sky was cloudy in that afternoon
The pavement was full of faces rapidly changing positions
The Neon lights called for dusk
The city of lunatics awoke to celebrate
Some left in agitation, the city wasn't doing them any good
They had a poor memory, the city remembered it all
Love never leaves a mother
The lunatics were busy writing scripts of melodrama
Love never left them, the mother inside them
Yet another afternoon, searching for a cup of peace, in a Jungle of concrete
They knew the ones who left
they loved them, they still do
Lunacy didn't conquer their memories
Mothers never stopped loving, they smiled
Dusk was approaching
In the translucence, they found it easier to see
All were traitors, all were children
they chose like mothers
The city of the lunatics Awoke again to celebrate, to love.
বছর বাইশের ছেলে হয়েও এখনো চিনি নি বাবুঘাট, কুমোরটুলি, শ্যামবাজার পাঁচমাথা, এলগিন রোড, ভালোবাসা কাকে বলে? বাবা খুব শখ করে একটা সাদা কালো টিভি কিনেছিলেন বটে শহরে এসে, তবে তাতে খবর কম, সাদা কালো দড়ি দড়ি লাইনগুলো কখনো সমান্তরাল আবার কখনো বা আড়াআড়ি ভাবে নিজেদের ইচ্ছেমতো খেলতো। আম্মা সন্ধ্যাহ্নিক সেরে বসে বসে বিজলী গ্রিল আর মার্গো সাবানের অ্যাড দেখতেন কতকটা হাঁ করে। মাঝে মাঝে ছন্নছাড়া মনে হয়। মনে হয় কোন ছিন্নমূল বটের যৌবন বয়সের চারা কে পাথুরে জমিতে এনে বসানো হয়েছে।
চৈত্রের দুপুর। রোদের তীব্র ঝাঁঝ শহর জুড়ে। এ সময়টায় খুব মন খারাপ হয়। গ্রামে আমাদের পাড়ার পাশেই শাঁখাড়ি পাড়া। আমি তখন কুড়ি। সদ্যই বলা চলে হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্টে বদলেছি নিজেকে। তোমায় দেখতাম রোজ একমনে। সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে শাঁখাড়ি পাড়া, আমাদের পাড়া পেরিয়ে চলে যেতে। কখন যে ফিরতে তা কোনোদিন দেখা হয় নি। শ্যামলা রংটাই তোমার জন্য যেন মানানসই ছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার খোঁপায় গোঁজা কাঠগোলাপের গন্ধ অনেকক্ষণ থেকে যেতো। ডুমুর গাছ, ফনিমনসা, অশোক গাছ পেরিয়ে আমার দৃষ্টি যেন তোমাকে ছাড়তেই চাইতো না। সেই তোমাকে ফেলে তলপি তলপা গুটিয়ে আজ এত দূরে। জানিনা ফের কবে তোমার শ্যামলা রঙের মানানসই চেহারাটা আবার দেখতে পাবো। শহরের অশ্বথ্থ গাছ গুলো মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে ডাকে আমায়। খুব করে যেন বলে - " এসো বসো আমার উঠানে, বুক ভরে নাও শ্বাস, শীতলপাটি বিছিয়ে দেবো তাল পাখার বাতাস "।
আম্মার শরীরটা দিন কতক হলো বেশ খারাপ। শহরে আসার পর থেকেই বাবাকে বলছেন - "মনো রে,এহানকার বাতাস আমার মোটে ঠিক লাগতেছে না। তর চোহে মুহে গুরুদশা র ছাপ ফুইট্টা উঠতেছে"। বাবা চুপ করে থাকেন। মা ছাদে উঠে বড়ি দেন হরেক রকমের - বিউলি, মূসুর, মটর ডালের বড়ি। রান্না শেষ করে সাবু জাল দিয়ে ঠান্ডা করে পাঁপড় বানিয়ে কৌটোয় ভরে রাখেন। আগাম বর্ষার মজুত খাবারের মধ্যে এগুলো পড়ে। আমি মাস্টার্স শেষ করে বসে আছি চাকরির আশায়। সিভি জমা দিয়েছি বেশ কিছু স্কুল আর প্রাইভেট কোম্পানিগুলোয়। লাভ হয়নি যদিও। শহুরে জল, হাওয়া বোধহয় আমারও ঠিক আনুকূল্যের নয়। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে একটা বাড়ি আছে, যার এক তলাটায় রোজই নাটকের মহড়া চলে। আমাদের বাড়ির ছাদ থেকে ওই বাড়ির জানালাটা দেখা যায়। কি সুন্দর সব অভিনয় করে ছেলেমেয়েগুলো। শুনেছি ওরা বিশেষত পথনাটক বা নাটিকা সম্পাদনা অভিনয় করে থাকে। বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপারটা। রোজই ওদের অভিনয় দেখি সন্ধ্যায় ছাদে গিয়ে। ইচ্ছে হয় আমারও ওদের সাথে অভিনয় করতে। ইচ্ছে হয় আবার তুলির টানে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলি নতুন কোন পারিজাত।
প্রজাদের দিকে তাকালেন ওইদিপাউজ। সান্ত্বনার সুরে বললেন-" হে আমার সন্তানবৃন্দ, তোমার এই দুর্ভাগ্যের কথা আমার অজানা নেই। আমি জানি কি ভয়ংকর সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছো তোমরা। কিন্তু আমি, তোমাদের রাজা, আমিও তো শান্তিতে নেই । ভেবে দেখো, তোমাদের যন্ত্রণা তোমাদের একার, প্রত্যেকের নিজস্ব, ব্যক্তিগত । আর আমার আত্মা অহর্নিশি যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে আমার নিজের জন্য, তোমাদের প্রত্যেকের জন্য, এবং এই থিবিস নগরীর জন্য।
" তুমিও বেরিয়ে এসো রাজা, তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই। মাঠের কাজ তোমার যক্ষ পুরীর কাজের চেয়ে অনেক সহজ। দূর থেকে ওই গান শুনতে পাচ্ছ রাজা?
— কিসের গান!
— পৌষের গান। ফসল পেকেছে, কাটতে হবে, তারই ডাক।
সহজ কাজটাই যে আমার কাছে শক্ত। সরোবর কি ফেনার নুপুর পরা ঝর্ণার মত নাচতে পারে ? যাও যাও, আর কথা কোয়ো না, সময় নেই। "
উদ্ভ্রান্ত বাইশ বছর একা হেঁটে যায়। তাল, সুপারি, জাম বন পেরিয়ে আবার আসে ডিঙি নৌকার কাছে। জাল বোনে, মাটির পুতুল গড়ে নানা ধরনের। ক্যানভাসের রং আর রং এর খেলায় মেতে গড়ে তোলে সূর্য, রোদ,জ্যোৎস্না, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপ আর শঠি বনের ঝোঁপ। অনেক নতুন নির্যাসে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে ছেলে। সে জানে রঙ্গমঞ্চ, সে জানে অভিনয়, সে জানে অতশী ফুল, এলগিন রোড, ভালোবাসার মানে।।
By Gayatri Roy
Comments